Wednesday, March 10, 2010

পাখির গ্রাম ভাটিনা

পাখির গ্রাম ভাটিনাযতই ভেতরে ঢুকছি ততই পাখির কিচিরমিচির শব্দ চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরছে। আমরা থমকে দাঁড়াই। বাঁশঝাড়ের ডালে ডালে শত শত পাখি। চড়ুই, শালিক, টিয়া, বক, মাছরাঙা, ঘুঘুসহ নানা রকমের পাখি। সবাই বুঝি আনন্দে চেঁচাচ্ছে সালেক খোকন
বন্ধু শামীমের বাসায় বেড়াতে এসেছি দিনাজপুরে। বিখ্যাত কান্তজী মন্দির, রামসাগর আর নয়নাভিরাম শালবন দেখে ভালোই কাটছে দিনগুলো। কাটারীভোগ চালের ভাতের সঙ্গে রুস্তম হোটেলের গরু ভুনা, মুন্সির হোটেলের খাসি আর ভাবির হাতের টাঁকিভর্তার স্বাদ নিয়েছি বারকয়েক।
শহরের একটু বাইরে বটতলীতে মালেকের বিখ্যাত চায়ের দোকান। মালাই দিয়ে চা খেতে খেতে ভাটিনা গ্রামের কথা শুনি। সেখানে নাকি নানা জাতের অনেক পাখি। ভাটিনা না দেখে চলে যেতে মন চাইল না। তাই দুপুরের পর শামীমের মোটরসাইকেলে রওনা হই আমরা। শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার। চিরিরবন্দরের রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে একটি বেইলি ব্রিজ পেলাম। ব্রিজে উঠে শামীম জানাল এটি গর্ভেশ্বরী নদী। এখন শুকিয়ে গেলেও একসময় নাকি এর গর্ভ স্পর্শ করা অসম্ভব ছিল। ব্রিজ পেরিয়ে মাস্তান বাজার। দেশের সবচেয়ে বড় টমেটোর বাজার এটি। বাজারের বাঁ দিক দিয়ে ইট বিছানো পথ গেছে ভাটিনায়। দুপাশে লিচু আর আমের বাগান। ঝাঁকড়া চুলের লিচুগাছগুলো দেখতে বেশ। গর্ভেশ্বরী পারের শ্মশানে পেঁৗছাই। কালীপূজার মেলা বসেছে। ভেসে আসে, 'ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে'।
গানে ভেসে দুই রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়াই। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধানক্ষেত। ভারী বাতাস সবুজ জমিনে ঢেউ তুলে ছুটে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ কৃষককে জিজ্ঞেস করে মেঠোপথ ধরে এগোতে গিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে লেখা 'পাখি সংরক্ষিত এলাকা, পাখি মারা নিষেধ'। বুঝতে পারি এসে গেছি ভাটিনা। বড় একটি পুকুর পেরিয়ে এগিয়ে যাই। গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক বাঁশঝাড়। যতই ভেতরে ঢুকছি ততই পাখির কিচিরমিচির শব্দ চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরছে। আমরা থমকে দাঁড়াই। বাঁশঝাড়ের ডালে ডালে শত শত পাখি। চড়ুই, শালিক, টিয়া, বক, মাছরাঙা, ঘুঘুসহ নানা রকমের পাখি। সবাই বুঝি আনন্দে চেঁচাচ্ছে। পাখিদের মহামিলন উৎসব যেন। আরেকটি বাঁশঝাড়ে সমবেত হয়েছে সহস্র পানকৌড়ি। একটি পানকৌড়িকে ছুটে পালাতে দেখে তাকিয়ে থাকি। দেখি একটি গোশালিক তাকে ঠোকর মারতে তাড়া করছে। পাখিদের আনন্দে আমরা আত্দহারা হয়ে যাই।
একটি আমবাগানে দেখলাম বাদামি রঙের বক আকৃতির অনেক পাখি। চোখ বুজে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। স্থানীয় একজন জানাল, এরা রাতচরা। মুচকি হেসে ভাবি, হয়তো এ কারণেই দিনে ঘুমাচ্ছে। ভাটিনার শত শত একর জমিতে টমেটো আবাদ হয়। একটি টমেটো বাগানে গিয়ে দেখি পাখিদের বসার জন্য বাঁশের ছোট ছোট কঞ্চি গেড়ে দেওয়া হয়েছে। পোকার হাত থেকে রেহাই পেতে এ ব্যবস্থা। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে খেয়ে যাচ্ছে সব পোকা। এভাবে কীটনাশক থেকে পরিবেশ বাঁচে, বাঁচে খরচও।
পাখি ওড়াতে স্থানীয় যুবক আকরামুল বিশেষ কায়দায় শব্দ করতেই ঘটে অবাক করা ঘটনা। হাজার হাজার পাখি গাছ থেকে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে ছুটতে থাকে। অল্পক্ষণে আকাশ ছেয়ে যায় পাখিতে। ভাটিনার বাসিন্দারা এ রকম মন জুড়ানো দৃশ্য দেখে প্রতিদিন। শত শত পানকৌড়ি, সাদাবক, কুনিবক, গুটকল, রাতচরা, ঘুঘু, শালিক, টিয়া আর ময়নার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে এ গ্রাম। এমনটি হয়েছে অনেক দিনের চেষ্টায়। কৃষক নূরু মিয়া জানালেন ১২ বছর আগের কথা। গোটা গ্রামেই ছিল পাখিদের আনাগোনা। ফাঁদ পেতে পাখি ধরা ছিল গ্রামবাসীর দৈনন্দিন ব্যাপার। বিত্তবানরা এয়ারগান চালাতেন দিনভর। দিনশেষে মোটরসাইকেলে মৃত পাখির ঝাঁক ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরত শিকারিরা।
আলোর ভুবন সমিতি প্রথম উদ্যোগ নেয় পাখির অভয়ারণ্য তৈরির। তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় স্থানীয় প্রভাবশালী হাশেম তালুকদার মেম্বার। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছেড়ে নিজের এয়ারগানটি ছুড়ে ফেলে দেন। শপথ নেন পাখি না মারার। সেই শুরু। গোটা গ্রাম মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে। পাখিদের সঙ্গে গ্রামবাসীর গড়ে উঠেছে আত্দার সম্পর্ক। ঝড়-বৃষ্টিতে ভাটিনাবাসী বেরিয়ে পড়ে কুলা হাতে। খুঁজে খুঁজে বের করে আহত পাখিগুলোকে। সাধ্যমতো চিকিৎসা দিয়ে বাসায় (বাঁশঝাড়ে) পেঁৗছে দিয়ে আসে।
সূর্য ডুবছে ভাটিনায়।
দূরে গিয়েছিল যারা তারা ফিরে আসছে। পুকুরে ঝাঁপিয়ে দিনশেষের ক্লান্তি দূর করছে কেউ কেউ। পাখিদের এসব দৃশ্য দেখলে কে আর ফিরতে চায়! আজও ভাটিনার কথা মনে হলে উদাস হয়ে যাই।
Source: Daily Kalerkantho
১৪ মার্চ ২০১০