নিরিবিলিতেই নির্বিঘ্ন জলার পাখি কালিম
টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে পাটনাই নদীর আলঙেরদুয়ার পৌঁছালেই সারি সারি হিজল-করচের বেষ্টনীর দেখা মিলবে। প্রাকৃতিক এই বেষ্টনী যেন হাওর থেকে নদীকে আলাদা করে রেখেছে। হিজল-করচের সবুজ সারির পরই হাওরের নলখাগড়ার ঝোপঝাড়। দূর থেকে কানে আসে পাখির ডানা ঝাপটানো, ওড়াউড়ি আর ডাকাডাকির শব্দ। চুপিসারে কাছে যেতে পারলে চোখ রীতিমতো ছানাবড়া হয়ে যাবে। বেগুনি পশম, কপালে লাল তিলকের ঝিলিক মেখে জলাভূমিতে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। শয়ে শয়ে পাখি প্রায় ১০-১২টি পালে বিভক্ত হয়ে কলরবে মেতেছে। জলার এ পাখির নাম—কালিম। কালিম পাখির নিবাস সিলেট ও মৌলভীবাজার বিস্তৃত হাকালুকি এবং সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে। পাটনাই নদীর আলঙেরদুয়ার পেরিয়ে জয়পুর থেকে গোলাবাড়ি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ নলখাগড়ার বন ও ঝোপঝাড়ে দেখা মেলে কালিম পাখির। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার পর ২০০৩ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরের ৪৬টি বিলের ইজারা প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। নিরিবিলি পরিবেশ পেয়ে কালিম পাখির সংখ্যা বাড়ছে বলে গ্রামবাসী জানায়। পাখিশুমারির তথ্যানুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরে কালিম পাখির সংখ্যা বেশি। গত শীতকালের পাখিশুমারি অনুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরে পাঁচ হাজারের বেশি এবং হাকালুকিতে দুই হাজারেরও বেশি কালিম পাওয়া গেছে। বিপদাপন্ন পাখি কালিম: পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, কালিম পৃথিবীর বিপদাপন্ন প্রজাতির জলাভূমির পাখি। বাংলাদেশে শুধু সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোর বন-ঝোপঝাড়ে এ পাখির বসবাস। পাখিটি দেখতে কুড়া বা মুরগির মতো। এ পাখির পরিচিতি প্রসঙ্গে পাখি বিশারদ শরীফ খানের বাংলাদেশের পাখি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, শুধু সিলেট অঞ্চলে বিচরণকারী কালিম পাখির নানা রকম নাম রয়েছে। ‘করমা’ নামেও পরিচিত এই পাখি। কালিম পাখি ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়। হাকালুকি হাওরে পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পের (সিডব্লিউবিএমপি) প্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা বশির আহমেদ বলেন, দিনের বেলা জলে ভাসমান লতাপাতা, কীটপতঙ্গ খায় এ পাখি। রাতে এরা জলাভূমির পাড়ে হিজল, করচ, বরুণের ঝোপঝাড়ে থাকে। নিরিবিলিই কী কাল?: বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও শীত মৌসুমে সিলেট নগরে পাখির বেচাকেনা বেড়ে যায়। পাখি বিক্রির এ চিত্রে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি ছাড়াও হঠাত্ দেখা মেলে জলাভূমির সৌন্দর্যখ্যাত বিপদাপন্ন কালিম পাখির। বিক্রেতার মুখে তখন শোনা যায়, ‘বিরল পাখির দ্বিগুণ দাম’। সাধারণত ব্যস্ত এলাকাগুলো পাখি বিক্রির স্থান হিসেবে চিহ্নিত। ব্যস্ততার আড়ালে চলে বিক্রি। বিক্রেতাদের ভাষ্য, কালিম পাখির অভয়ারণ্য নিরিবিলি হওয়ার সুযোগে শিকারিরা ফাঁদ পেতে অক্ষতভাবেই পাখি তাদের হাতে তুলে দেয়। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পরিদর্শক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘শিকারিদের তত্পরতা এত আড়ালে চলে যে হাতেনাতে ধরা খুব কঠিন।’ সিলেট বিভাগীয় বন সংরক্ষক (ডিএফও) মো. দেলওয়ার হোসেন জানান, বন বিভাগের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির তত্ত্বাবধানে পাখি বিক্রি বন্ধে তত্পরতা চালানো হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, যখন এ কমিটি বাজারে যায়, তখন পাখি বিক্রেতারা আড়ালে চলে যায়। তবে বাংলাদেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট অঞ্চলের সমন্বয়কারী আয়েশা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাখি শিকার ও বিক্রি দুটোই যেহেতু আইনত নিষিদ্ধ, তাই এ দুই ক্ষেত্রে সমান আইনি পদক্ষেপ চালানো যেতে পারে। শিকার বন্ধ হলে বিক্রেতা বিক্রির জন্য পাবে না। এ জন্য শুধু আইনি পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতার।’
Source:
No comments:
Post a Comment