Friday, October 29, 2010

সাজেক উপত্যকায় অসময়ে পরিযায়ী পাখি

সাজেক উপত্যকায়

অসময়ে পরিযায়ী পাখি

রেজা খান | তারিখ: ২৯-১০-২০১০



পরিযায়ী পাখি কেবল এ দেশে আসে শীতকালে, প্রচলিত এ ধারণা সাজেক উপত্যকায় এসে ভুল হতে বসেছে। বৃষ্টির পর খানাখন্দের জমে থাকা পানিতে একজোড়া খঞ্জন পাখি দেখে অবাক মানতেই হয়। এ সময়ে এই পাখি এখানে থাকার কথা নয়!

সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে কঙ্গলাক মৌজার ছিপুই পাড়া বড়জোর তিন কিলোমিটার। কিন্তু বেশির ভাগ সময় পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে ওপরের দিকে ওঠার পথে যে কারও গতি শ্লথ হয়ে আসবে। আমাদের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হলো না। সঙ্গী আমার ছাত্র দীপু ও মাসালং বন রেঞ্জের একজন ফরেস্টার, ওপরে ওঠে ছিপুইয়ের দিকে হাঁটা শুরু করলাম আমরা।
রুইলুইয়ের কর্তাব্যক্তি বা হেডম্যান লাল থাঙ্গা লুসাইয়ের বাড়ির উঠান থেকে সোজা উত্তরে তাকালে পাহাড়চূড়ায় যে টিনের ঘরটি দেখা যায়, সেটি একটি গির্জা।
ইচ্ছা না থাকলেও কৌতূহল হলো ওদিকটা ঘুরে আসার। কারণ, এখনো সাজেকের বিখ্যাত কমলাবাগানের চেহারা দেখার সুযোগ হয়নি। এখানে আশপাশে যা দেখেছি, তা প্রায় মরতে বসা জীর্ণ-শীর্ণ দু-একটি গাছ, এখনো দাঁড়িয়ে আছে কোনো রকমে।
পাহাড়িদের দুটো পাড়ার মাঝখানে বিডিআরের এক চৌকি। বড় একটা জায়গাজুড়ে, প্রায় দুটি পাহাড় আর সঙ্গের ছোট্ট উপত্যকাও পড়েছে এই চৌকির চৌহদ্দিতে।
বিডিআর ছাড়া প্রত্যন্ত এ এলাকার চারটি মৌজার সব মানুষই কোনো না কোনো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীভুক্ত, বেশির ভাগ সনাতনধর্মাবলম্বী। তবে মিজোরাম থেকে আসা পাংকুয়া ও লুসাইরা খ্রিষ্টান।
ক্যাম্পের পরেই একটি মেঠোপথ ডানে মোড় নিয়েছে, যা কঙ্গলাক ও রুইলুইয়ের সংযোগ সড়ক। মোড় ঘুরতেই দেখলাম একটু আগের বৃষ্টির পানি জমে আছে নিচু খানাখন্দে, আর এ রকম এক খন্দের পাড়ে তিড়িংবিড়িং করে নাচছে একজোড়া খঞ্জনি পাখি।
অবাক হলাম। কারণ, শীত ও এর আশপাশের সময় ঢাকার নর্দমা থেকে শুরু করে দেশের যেকোনো এলাকার সামান্য জলময় অংশে, নদীর পাড়ে, মোহনা, উপকূলে কিংবা অন্য যেকোনো জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখির দারুণ আনাগোনা থাকে। কিন্তু এই শরতে কঙ্গলাকের রাস্তার পাশে খঞ্জনি পাখি এল কী করে!
আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, পরিযায়ী পাখি মানেই শীতকালে দূরদেশ থেকে আসা হাজার হাজার পাখি, যা আমাদের বিল-বাঁওড়, হাওর এবং চর ও মোহনা অঞ্চলে বিচরণ করে। এদের মধ্যে প্রধান হলো হাঁস, রাজহাঁস, চখাচখি, জলাভূমির বা উপকূলীয় পাখির মধ্যে যেমন চা-পাখি, কাদাখোঁচা, বাটান, গুলিন্দা, জলকবুতর, গাঙচিল এবং আরও কিছু জলচর পাখি।
আসলে আমাদের দেশে যেসব পরিযায়ী পাখির দল প্রধানত শীত (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) পাশের ভারতীয়-নেপালি-চৈনিক-তিব্বতীয় হিমালয় পর্বতমালা ও এর পাদদেশাঞ্চল এবং মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, ইউরেশিয়ার সাইবেরিয়া এবং ইউরোপ ও দূরবর্তী পূর্ব এশিয়ার কিছু কিছু দেশ থেকে আসে, তাদের মোটামুটি চারটি দলে ভাগ করা যায়।
প্রথম ও প্রধান দলে আছে শীত মৌসুমে আসা সবচেয়ে বড়সড় জলচরি এবং ঝোপঝাড়, বনবাদাড় ও জনবসতিতে এসে থানা গাড়ে কিন্তু চোখে পড়ে না, আর দেখতেও বেশ ছোট—এমন সব পাতাফুটকি (লিফ ওয়ার্বলার), চটক (ফ্লাইক্যাচার), কসাই পাখি (শ্রাইখ), ছাতারে (ব্যাবলার), ভরত বা মাঠ-চড়াই কিংবা পিপিট, আর বড় আকারের ইগল, চিল, বাজ ও পেঁচা।
দ্বিতীয় বা গ্রীষ্মের পরিযায়ী পাখির দলে আছে বেশির ভাগ কোকিল বা পাপিয়া, চাতক, সরগম (কুকু) এবং সুমচা (পিট্টার) দল ও সম্ভবত কিছু গাঙচিল বা মোহনাঞ্চলের পাখি। এরা আমাদের দেশে আসে প্রজননের জন্য।
তৃতীয় ও চতুর্থ দলের পরিযায়ী পাখিরা আসে বসন্তে ও শরতে। এ সময় তারা আমাদের দেশে আসে মূলত অনেকটা চলার পথের পথিক অথবা পরিযায়ী পাখি বা প্যাসেজ মাইগ্রান্ট হিসেবে। কারণ এ দুই সময়ে আমাদের দেশে যেসব পরিযায়ী প্রজাতি আসে, তারা একাকী, জোড়ায় কিংবা সামান্য কয়েকটি পাখি নিয়ে গড়া ছোট্ট দলে আসে। আমাদের দেশকে আসলে এসব পাখি ব্যবহার করে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে। যে কারণে এ দেশে তারা সামান্য বিরতি দিয়ে বিশ্রাম নিয়ে—কয়েক ঘণ্টা, এক রাত বা কেবল কয়েক দিন থেকে ভালো খাবারদাবার খেয়ে আবার রওনা হয় আসল গন্তব্যস্থল দক্ষিণ বা উত্তরের কোনো দেশের উদ্দেশে।
আর এ রকম একটি দল এখন দেশের ওপর দিয়ে পার হচ্ছে, ওই পাখি সেই দলেরই একটি।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমি ঢাকায় চলার পথে পাখির যে প্রজাতি দেখেছি, তার মধ্যে অন্যতম বাদামি কসাই পাখি (ব্রাউন শ্রাইখ), লালগলা চটক (রেড-থ্রোটেড ফ্লাইক্যাচার) ও সাদা খঞ্জনি। ঢাকার বাইরে থেকে শুরু করে সুদূর সাজেক-কঙ্গলাক পর্যন্ত দেখেছি, এ তিন প্রজাতি বাদে আবাবিল (বার্ন সোয়ালো), সোনা বউ (ব্ল্যাক-নেকড ওরিয়ল), ধূসর ফিঙে (গ্রে ড্রোঙ্গো), সুচ-লেজ (নিডল-টেইল), নীল চটক (ব্লু ফ্লাইক্যাচার), লাল ফিদ্দা বা লাল চ্যাট (কমন স্টোনচ্যাট), পাতাফুটকি (লিফ ওয়ার্বলার), চা-পাখি (স্যান্ডপাইপার), লাল পা পিউ (রেডস্যাঙ্ক), ভুবন বা বাদামি চিল (ব্ল্যাক-ইয়ারড কাইট), সাদাটে মেঠোচিল (প্যালিড হ্যারিয়ার) ইত্যাদি।
শরতের পাখির মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে বাদামি কসাই, সাদা খঞ্জনি ও আবাবিল পাখি।
আমার মনে হয়, দেশে কেবল শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখিরা আসবে, সে ধারণায় বলিয়ান না হয়ে পাখিবিজ্ঞানী, পাখিপ্রেমিক বা প্রকৃতিপ্রেমিকদের উচিত আর কোথাও যেতে না পারলে নিদেনপক্ষে ঢাকার উদ্ভিদ উদ্যানে, গ্রীষ্ম, শরৎ ও বসন্তের পাখিদের পর্যবেক্ষণ করা, যাতে আমাদের দেশে আসা সব ধরনের পরিযায়ী পাখির সঠিক শুমার করা যায়।
Source: Daily Prothom-Alo

No comments:

Post a Comment