Friday, September 10, 2010

বাঁচতে এসেছিল ওরা! প্রকৃতির সন্তান

বাঁচতে এসেছিল ওরা!

দূরদেশের প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচতে এসেছিল ওরা। আশ্রয় নিয়েছিল এ দেশেরই এক হাওরে। নির্ভাবনায় ঝাঁক বেঁধে হুটোপুটি করতে করতে খাবার খুঁজছিল। একপর্যায়ে পেয়েও যায় লোভনীয় খাবার। কিন্তু সে খাবার খেয়ে সতেজ হয়ে ওঠেনি ওরা। বরং নিস্তেজ হয়ে একে একে হারিয়ে যায় মৃত্যুর ঠিকানায়। এভাবে পাখিশিকারিদের বিষটোপের বলি হয় অতিথি পাখিগুলো।
গত সোমবার বিকেলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওরের চান্দের বিল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে ৩২টি মৃত পাখি উদ্ধার করা হয়েছে। বিষটোপ খেয়ে স্থানীয় একটি খামারের প্রায় ২৫০টি হাঁস মারা যায়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পরিবেশ অধিদপ্তরের গ্রাম সংরক্ষক দলের (ভিসিজি) দুই পাহারাদার আজির উদ্দিন (৪০) ও ছনু মিয়াকে (৫০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে এই দুজনসহ চারজনের বিরুদ্ধে বড়লেখা থানায় বন আইনে মামলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, উপজেলা প্রশাসন ও হাকালুকি হাওরের উন্নয়নে কর্মরত পরিবেশ অধিদপ্তরের উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (সিডব্লিউবিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার বেলা তিনটার দিকে সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি গ্রামের মুসলিম আলী ও সামছু মিয়া মাছের ঝুড়ি নিয়ে চান্দের বিল এলাকা থেকে আজিমগঞ্জ বাজারে ফিরছিলেন। পথে সন্দেহ হলে সিডব্লিউবিএমপির ভিসিজি পাহারাদার আজির উদ্দিন ও ছনু মিয়া তাঁদের আটকান।
পুলিশের কাছে দেওয়া আজির উদ্দিন ও ছনুর ভাষ্যমতে, মাছের ঝুড়ির ঢাকনা খুলে তাঁরা বেশ কিছু মৃত অতিথি পাখি দেখতে পান। এ সময় বিপদ টের পেয়ে মুসলিম ও সামছু ওই ঝুড়ি ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যান।
ঘটনা জানাজানি হলে স্থানীয় সুজানগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, সিডব্লিউবিএমপির কুলাউড়া কার্যালয়ের উদ্যান কর্মকর্তা আবদুল মালেক, বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার কার্যালয়ের রেঞ্জ কর্মকর্তা মিয়া সিরাজুল হক ঘটনাস্থলে যান।
আবদুল মালেক জানান, তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে পাতি সরালি ও লেনজা হাঁস জাতের ৩২টি মৃত অতিথি পাখি উদ্ধার করেন। পাখিগুলো জবাই করা ছিল।
বড়লেখা থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন জানান, অতিথি পাখি নিধনের ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে সোমবার রাতে মিয়া সিরাজুল হক বাদী হয়ে মুসলিম আলী, সামছু মিয়া, আজির উদ্দিন ও ছনু মিয়ার বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছেন। শিকারিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগে আজির ও ছনুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বড়লেখা উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, বিষটোপ খেয়েই পাখিগুলো মারা গেছে। বিষের ধরন পরীক্ষা করতে চারটি মৃত অতিথি পাখি ঢাকার কেন্দ্রীয় পশুরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগারে পাঠানো হচ্ছে।

প্রকৃতির সন্তান

কবি রণজিত্ দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, বৃক্ষে হাত রেখে কবি টের প্রায় প্রাণ, আর ব্যবসায়ী দেখে কেবলই কাঠ। যখন হাকালুকি হাওরে হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে কেউ দেখে প্রকৃতির অপরূপ লীলা, তখন একদল শিকারি দেখে একগুচ্ছ স্বাদু মাংসের ওড়াউড়ি। অথচ পাখি হলো প্রকৃতির শিশু। পাখির সৌন্দর্য আমাদের মধ্যে মমতার অনুভব জাগায়। অথচ এসব ভুলে অতিথি পাখি শিকার করা বা তার মাংস খাওয়ার জন্য বিক্রি করা হয়। এটা কেবল নিষ্ঠুরতাই নয়, বর্বরতারই নামান্তর। প্রতিবছর শীতের শেষাশেষি আমাদের বিল-হাওরগুলো দূর-দূরান্তর থেকে আসা নানা জাতের অতিথি(নাকি পরিযায়ী?) পাখিতে ভরে যায়। এবারও তাই ঘটেছে হাকালুকি হাওরে (সূত্র: প্রথম আলো, ১১ জানুয়ারি)। দর্শনার্থীদের উত্পাত, পাখিভক্ষক শিকারিদের আক্রমণ যেখানে থাকে না, সেখানে রংবেরঙের অজস্র পাখিতে স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তা কেবলই দেখার জিনিস, খেয়ে ফেলার জিনিস নয়! তার পরও একশ্রেণীর মানুষ পাখির মাংসের লোভ সংবরণ করতে পারে না। এমনকি অনেক হোটেলকেও পাখির মাংসের রান্না পরিবেশনের বড়াই করতে দেখা যায়। তারা কি ভেবে দেখেছে, কেবল রসনা আর ব্যবসার জন্য তারা শুধু প্রকৃতিরই ক্ষতি করছে না, মানুষ হিসেবেও অনেক হীন কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কিছু মানুষ সাধারণত মৌসুমি পেশা হিসেবে পাখি শিকার করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের জন্য নয়, শহর-বাজারে বিক্রির জন্যই তারা ফাঁদ পেতে পাখি ধরে বা শিকার করে। তাই, তাদের কাছ থেকে পাখি কেনা বন্ধ করলে শিকারিরা নিরুত্সাহিত হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীলতা প্রয়োজন পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ পুলিশ প্রশাসনের। এমনকি যেসব এলাকার বিল-হাওর-জলাশয়ে অতিথি পাখির সমাগম হয়, সেসব এলাকার স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদেরও উচিত এগিয়ে আসা।
Source: www.krishe.com

No comments:

Post a Comment